সাইবার নিরাপত্তা আইন সাধারণভাবে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার করে সংগঠিত অপরাধ, যেমন ডেটা চুরি, ফিশিং, সাইবার আক্রমণ ইত্যাদির বিরুদ্ধে সৎ ও নিষ্পাক্ষ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রণীত হয়। সম্প্রতি বাংলাদেশের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন DSA বাতিল করে নতুন একটি আইন করার সিদ্ধান্তে সম্মতি দিয়েছে বাংলাদেশের মন্ত্রিসভা। নতুন এই আইনটির নামকরণ করা হচ্ছে সাইবার নিরাপত্তা আইন ২০২৩ । যাতে মোট ৭টি ধারা থাকবে।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বেশ কয়েকটি ধারা পরিবর্তন করে নতুন এই আইনটি করা হচ্ছে। অর্থাৎ আগের আইনের বেশিরভাগ ধারাই নতুন আইনে থাকছে। তবে কিছুটা পরিবর্তিত হয়ে।
সাইবার নিরাপত্তা আইন কি?
“সাইবার নিরাপত্তা আইন” হলো ঐক্যরাষ্ট্রে সাইবার স্পেস ও সাইবার জগতে নিরাপত্তা বজায় রাখার জন্য গঠিত আইনগুলির সমূহের সমষ্টি। সাইবার নিরাপত্তা আইন বৈশিষ্ট্যপূর্ণভাবে সাইবার স্পেসে হ্যাকিং অপরাধ, ডেটা চুরি, অপরাধী কার্যকলাপ ইত্যাদির প্রতিরোধ ও শাস্তিপ্রদান সংক্রান্ত নীতি, আদর্শ, ব্যবস্থা এবং আইনের সমষ্টি বোঝায়।
কোন কোন ধারাগুলো পরিবর্তন হচ্ছে নতুন আইনে?
সাইবার নিরাপত্তা আইনে যেসব ধারাগুলো পরিবর্তন হচ্ছে তার মধ্যে অন্যতম ধারা-২১ । আগে ২১ ধারায় অভিযুক্ত কাউকে ১০ বছরের কারাদণ্ড এবং এক কোটি টাকা জরিমানার বিধান ছিল, এবং দ্বিতীয়বার একই অপরাধ করলে এই সাজা দ্বিগুণ হওয়ার বিধান ছিল। ওই একই ব্যক্তি যদি বারবার ২১-ধারায় অভিযুক্ত হন, তাহলে তাঁর বিরুদ্ধে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ৩ কোটি টাকার জরিমানার বিধান ছিল।
পরিবর্তিত নতুন আইনে সাজার মেয়াদ ১০ বছর থেকে কমিয়ে ৭ বছর করা হয়েছে। তবে এখানে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং দ্বিতীয়বার একই অপরাধ করলে দ্বিগুণ শাস্তির বিধান বাতিল করা হয়েছে।
অপরিবর্তিত থাকছে ধারা-৪৩
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সবচেয়ে বিতর্কিত ধারা ছিল ধারা-৪৩। যে ধারাটি নতুন আইনেও সম্পূর্ণ অপরিবর্তিত থাকছে। ৪৩-ধারা অনুযায়ী যে কোনও সন্দেহভাজন ব্যক্তি সাইবার নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে, এই সন্দেহে পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করতে পারে।
তথ্য ও মত প্রকাশ নিয়ে যুক্তরাজ্য ভিত্তিক কাজ করা একটি সংগঠন, Article 19 বলছে, বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি অপব্যবহার হয়েছে এই ধারার। ধারা-৪৩ ব্যবহার করে ২০১৮ সালের অক্টোবর থেকে 2023 সালের মার্চ পর্যন্ত ৬৭০টির বেশি মামলা করা হয়েছে। এবং এতে অভিযুক্ত করা হয়েছে ১১৩৬ জনকে।
তার মধ্যে ৪০৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এবং এদের বেশিরভাগকে গ্রেফতারের পর মামলা দেওয়া হয়েছে। এবং দেখা গেছে এসব মামলার প্রায় ৪০% প্রধানমন্ত্র, প্রধানমন্ত্রীর আত্মীয় স্বজন, মন্ত্রী বা সরকারদলীয় বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদেরকে কটূক্তির অভিযোগে মামলাগুলো করা হয়েছে।
অন্যদিকে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এ বছর জুন মাসে সংসদে জানান, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিভিন্ন ধারা ব্যবহার করে সারা দেশে প্রায় ৭০০০ এর বেশি মামলা করা হয়েছে। তার মধ্যে প্রায় ৫ হাজারের বেশি মামলা, এখনও বিচারাধীন অবস্থায় আছেন।
আরো পড়ুন: পারমানবিক বোমার জনক ওপেনহাইমার এর জীবন কাহিনী। Atomic Bomb
নতুন আইনে থাকছে জামিনযোগ্য বিধান
আগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বেশ কিছু ধারায় জামিন দেওয়ার কোনও বিধান ছিল না। যেটি নতুন সাইবার নিরাপত্তা আইনে সংযোজজন করা হচ্ছে। যেমন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৮-ধারায় পাঁচ বছরের কারাদণ্ড এবং ১০ লক্ষ টাকা জরিমানার বিধান ছিল। এবং একই অপরাধ বারবার করলে সেখানে জরিমানা এবং কারাদণ্ড দ্বিগুণ করার বিধান ছিল।
নতুন আইনে এই ধারায় সাজার মেয়াদ কমানো হয়েছে এবং এই ধারায় অভিযুক্ত ব্যক্তিকে জামিন দেওয়ার বিধান রাখা হয়েছে।
কারাদণ্ড থাকছে না, ২৯-ধারায়
নিরাপত্তা আইনের ২৯-ধারায় অভিযুক্ত ব্যক্তিকে তিন বছরের কারাদণ্ড এবং ৫ লক্ষ টাকার জরিমানার বিধান ছিল। এবং একটি অপরাধ বারবার করলে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড এবং ১০ লক্ষ টাকার জরিমানার বিধান রাখা হয়েছিল। নতুন আইনে এই ধারায় কোনো ধরনের কারাদণ্ডের বিধান রাখা হচ্ছে না। শুধুমাত্র জরিমানা দিতে হবে।
পূর্বের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে হ্যাকিং নিয়ে খুব বেশি বিস্তারিত কিছু না থাকলেও নতুন আইনে হ্যাকিং নিয়ে বেশ কিছু নতুন ধারণা দেওয়া হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩২-ধারায় সরকারি গোপনীয়তা ভঙ্গের অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে ১৪ বছরের কারাদণ্ডের বিধান ছিল। যেটি কমিয়ে অর্ধেক করা হয়েছে। অর্থাৎ ৭ বছর।
অন্যদিকে এই একই অপরাধ বারবার করলে তার সাজার মেয়াদ দ্বিগুণ করার যে বিধান সেটিও বাতিল করা হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩৩-ধারাও বিলুপ্ত করা হয়েছে এবং সেখানে হ্যাকিং সম্পর্কিত আইন নামে একটি নতুন আইন প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। নতুন এই আইনে অনধিক ১৪ বছর কারাদণ্ড অথবা ১ কোটি টাকার সর্বোচ্চ জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে।
তথ্যপ্রযুক্তি সংক্রান্ত অপরাধ নিয়ে ২০০৬ সালে বাংলাদেশে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন প্রণয়ন করা হয়, যা আইসিটি আইন নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। 2016 সালে এ আইনটিকে আরও কঠোর করে প্রণয়ন করা হয়। এই সময় আইনটির ৫৭ ধারা নিয়ে তুমুল বিতর্ক সৃষ্টি হয় এবং সেটি বাতিলের দাবি ওঠে। এরপর 2018 সালের জানুয়ারিতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নামে নতুন একটি আইনের খসড়া অনুমোদন করে মন্ত্রিসভা।
যে আইনটি অপব্যবহার এবং বাক স্বাধীনতা রোধের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে এমন অভিযোগ এ দেশে বিদেশে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে। এরই মাঝে নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রায় একই ধরনের একটি আইন নতুন একটি নাম দিয়ে কার্যকর করতে যাচ্ছে সরকার।